শামীম ইকবাল চৌধুরী,নাক্ষ্যিংছড়ি (বান্দরবান) থেকেঃ

আরকান রাজ্যসহ ১৪টি ষ্টেটের মধ্যে ৯টিতে যুদ্ধসহ নির্যাতন,নিপীড়ন অব্যাহত রয়েছে মিয়ানমারে।এই ৯টি ষ্টেটের মধ্যে আকিয়াব,বুথিদং ও মংডু। এ তিনটি ষ্টেটের দুইটির এপারে বাংলাদেশ দক্ষিণ শেষ সীমান্ত নাফ নদী, নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধূমের তুমব্র খাল, লেম্বুছড়ির ৫০ বিওপি, পাইনছড়ির ৫১, ৫২ বিওপি, চাক্ঢালার চেরারমাঠের ৪৪,৪৫ বিওপি ও কম্বুনিয়ার ৪৬,৪৭ নং বিওপি পয়েন্ট রয়েছে। এ পয়েন্ট গুলোর ওপাড়েই মংডো থানা আর বুথিদং থানা । আরাকান রাজ্যের এই আকিয়াব জেলাসহ বুথিদং ও মংডো অঞ্চলেই বসবাস রোহিঙ্গামুসলিম ও হিন্দুদের বসবাস। এক সময় বঙ্গের পূর্বাঞ্চল থেকে মানুষেরা মংডো ও বুথিদং গিয়ে বসত শুরু করেছিল। সম্ভবত পনেরো শ’ শতকে। অথবা তারও আগে। মানুষ গিয়েছে ইংরেজ আমলে। গিয়েছে ইংরেজ বার্মিজ যুদ্ধের পর। গিয়েছে একাত্তরেও। তিনটি অঞ্চল, দু,টি নদীর এপার ওপার। ওপারে নির্যাতন,নিপীড়ন ও হানাহানি মত ঘটনা সংগঠিত হলেই চলে আসতে হয় এপারে। এভাবেই তো রোহিঙ্গারা কষ্টে বেঁচে আছে পৃথিবীর সর্বত্রে।

মিয়ানমারের রাখাইন বা আরাকান রাজ্যের রোহিঙ্গারা আক্ষরিক অর্থেই দেশহীন মানুষ, কোনও দেশই তাদের দেশ নয়। মিয়ানমারে বংশ পরম্পরায় বাস করেও তারা মিয়েনমারের নাগরিক নয়। তাড়া খেয়ে বাংলাদেশে, ইন্দোনেশিয়ায়, মালয়েশিয়ায় , থাইল্যান্ডে বা ভারতে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা সেসব দেশেরও নাগরিক নয়। সব দেশেই তারা শরণার্থী। অনাকাক্ষিত শরণার্থী। আর সব রোহিঙ্গা মুজাহিদিন নয়, সব রোহিঙ্গাই জিহাদি নয়। বেশিরভাগ রোহিঙ্গাই সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। বেশিরভাগ রোহিঙ্গাই শান্তিতে বাস করতে চায়, জীবনের নিরাপত্তা চায়।

রোহিঙ্গা মুসলমানেরাা উড়ে এসে জুড়ে বসা কোন জাতি বা গোষ্টি নয় :

ইতিহাস বলে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানেরা উড়ে এসে জুড়ে বসা কোন জাতি বা গোষ্টি নয়। তারা সেখানে অবস্থান করছেন আদি নিবাস সূত্রেই। মিয়ানমারে রাখাইন সম্প্রদায়ের এককালে স্বাধীন ভূখণ্ড ও রাজ্য ছিল।

এই ভারতীয় উপমহাদেশ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সর্বপ্রথম যে কয়টি এলাকায় মুসলিম বসতি গড়ে ওঠে,

আরাকান তার মধ্যে অন্যতম। রোহিঙ্গারা সেই আরাকানী মুসলমানের বংশধর। এক সময় আরাকানে স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ১৬৬০ সাল থেকে আরাকান রাজা থান্দথুধম্মার আমল থেকে এখন পর্যন্ত মিয়ানমারের মুসলমানদের উপর চলে আসছে অবর্ণনীয় নিষ্ঠুর অমানবিক অত্যাচার নিপীড়ন। এর মাঝে ১৯৩৭ সালে বার্মা স্বায়ত্তশাসন লাভের

পর বৌদ্ধদের পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ব্যাপক রূপ নেয় এবং তারা প্রায় ৩০ লাখ মুসলিম হত্যা করে। ১৯৪৮ সালে বার্মা স্বাধীনতা লাভ করার পর ও এ নির্যাতন অব্যাহত থাকে। উল্টো ১৯৮২ সালে মিয়ানমারের সরকার

সরকারি ভাবে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাগরিকত্ব বাতিল করে দেয়। তাদেরকে সে দেশে নাগরিকের বদলে বলা হয় “বসবাসকারী” সেখানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের সরকারীভাবে ভোটাধিকার, সাংবিধানিক ও সামাজিকসহ কোন মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়না। এরই মাঝে ২০১২ সাল থেকে মিয়ানমারের সরকারও সেখানকার রাখাইন সম্প্রদায় এক সাথে একরকম ঘোষণা দিয়েই আবার মুসলিম নিধন যজ্ঞ শুরু করে।

সাম্প্রতিক এ দাঙ্গাকে বৌদ্ধ-মুসলিম জাতিগত দাঙ্গার নাম দিয়ে এর আড়ালে থাকা সাম্প্রদায়িক হামলাকে গোপনের

চেষ্টা করে সে দেশের সরকার। মিয়ানমারে বৌদ্ধদের প্রাধান্য, ফলে দেশটির প্রচারমাধ্যম বৌদ্ধদের নিয়ন্ত্রণে। ফলে মুসলমান বা রোহিঙ্গাদের উপর অত্যাচার ও নিপীড়নের সঠিক তথ্য প্রচার করা হয়না সেখানে।এতে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর অতিরিক্ত উদাসীন তা পরিলক্ষিত হয়েছে।

মিয়ানমারে আরকান রাজ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের বসবাস :

রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি অনেক হিন্দুও বাস করে আসছে দীর্ঘ বছর ধরে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও উগ্রপন্থী মগরা (রাখাইন) শুধু আরাকানে বাসকারী রোহিঙ্গা মুসলিমদের অত্যাচার করে না, বাংলাভাষী সব ধর্মের মানুষকে অত্যাচার করে। তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয় এবং সহায়সম্পদ লুট করে। হিন্দুদেরকে মিলিটারি ও মগরা ‘ইন্ডিয়ান অভিবাসী’ নামে অভিহিত করে। আর রোহিঙ্গাভাষী মুসলিমদের বাংলাদেশ থেকে ‘অবৈধভাবে আসা বাঙালি’ হিসেবে চিহ্নিত করে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক বাংলায় কথা বললে বলা হয় বহিরাগত। কিন্তু মিয়ানমারে বসবাসকারী হিন্দিভাষীদের সে দেশের সংবিধানে ‘ইন্ডিয়ান’ নামে স্বীকৃতি দেয়া হলেও রোহিঙ্গাভাষী অর্থাৎ চাটগাঁওভাষী হিন্দু বা মুসলমানকে সে দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না। ১৯৮২ সালের একটি আইনে এদের নাগরিকত্ব হরণ করা হয়েছে। এভাবে মিয়ানমার শাসকেরা যুগ যুগ ধরে এক রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ‘বাঙালিদের’ ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে বলে নির্যাতিত হয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানান।

আরাকান রাজ্যে এখনো আগুন, গুলি ও মাইনের আতঙ্কে মুসলমান ও হিন্দুরা :

অসুস্থ রোহিঙ্গা ও হিন্দুদের মাথা, গলা, হাতে ও পায়ে মিয়ানমারের সেনাদের গুলির ক্ষত। চোখেমুখে ভয় ও আতংকের ছাপ। শরীরের এখানে সেখানে কাটাছেড়ার দাগ। এসবের মধ্যে রয়েছে- শিশু, কিশোর ও বৃদ্ধা। অনেকের জীবন সংকটাপন্ন বলে জানান চিকিৎসকরা। আহতরা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে পারছে না। নির্যাতনের বর্ণনা দেয়ার সময় চোখ থেকে পানি ঝরছিল। আগুন ও গুলি থেকে কোনোমতে প্রাণ বাঁচিয়ে সীমান্ত পেরোতেই পুঁতে রাখা স্থল মাইনের সামনে পড়ছে রোহিঙ্গারা। এতে কারো হাত, কারো পা বিচ্ছিন্ন হয়েছে। কারো সারা শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে মিশে গেছে মাটির সঙ্গে। রোহিঙ্গাদের প্রতিকূল অবস্থাকে অনুকূলে আনা তো দূরের কথা। আগের প্রতিকূল অবস্থাকে বলবান রাখতে সীমান্তে বসানো হয়েছে মাইন ও বিস্ফোরক। মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও সীমান্ত বাহিনী বিজিপি দু’দেশের সীমান্ত রেখা ঘেষে স্থাপন করেছে স্থলমাইন ও উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক যা রোহিঙ্গাদের আতঙ্কের মাত্রাকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। ইতোমধ্যে এসব স্থলমাইন বিস্ফোরণে বৃদ্ধি পেয়েছে মৃতের সংখ্যা। আর আহতের ঘটনা তো নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা যেন ফের মিয়ানমারে প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্যই এই অভিনব কায়দার আবির্ভাব ঘটিয়েছে বিজিপি। যার দরুণ আরাকান রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মাঝে দেখা দিয়েছে মৃত্যুঝুঁকি। ‍ইতোমধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশান্তরীণ হতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশী নাগরিক। এদিকে ২৬ আগস্ট থেকে ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে স্থলমাইন বিস্ফোরণে নারীসহ ৬ জন নিহত এবং ৫ জন আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

পালিয়ে আসা রোহিঙ্গদের খাদ্য ও আবাসন সংকটঃ

সর্বস্ব হারিয়ে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের খাদ্য ও আবাসন সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। ত্রাণের জন্য হাহাকার করছে হাজারো রোহিঙ্গা। ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত এসব রোহিঙ্গা গাড়ি দেখলেই খাবারের আশায় হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হলেও তা অপ্রতুল। আবাসন সংকটে স্ত্রী পরিজন নিয়ে রোহিঙ্গারা উখিয়া-টেকনাফ সড়কের দু’পাশে মানবেতর সময় পার করছে। বিশেষ করে খাবার পানির সংকটের কারণে শিশুরা বিভিন্ন রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে বলে জানা গেছে। আর এদিকে রোহিঙ্গা শিশুরা কাঁদা ময়লাযুক্ত জায়গায় পলিথিনের নিচে আশ্রয় নিয়েছে। বেসরকারিভাবে যেসব ত্রাণ সামগ্রী দেয়া হচ্ছে তা নতুন রোহিঙ্গারা পাচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। উপজেলা প্রশাসন ত্রাণ সামগ্রী বিতরণে মনিটরিং করলেও রোহিঙ্গাদের ঢলে সিমান্ত ঘুমধূমে নতুন ও পুরাতন রোহিঙ্গা চিহ্নিত করতে সক্ষম না হওয়ায় বেশিরভাগ ত্রাণ সামগ্রী পুরাতন রোহিঙ্গারা ভোগ করছে বলে নতুন রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন।

মজলুম রোহিঙ্গা ও হিন্দুদের সাহায্য দিয়ে বাঁচাতে হবে :

রোহিঙ্গারা মূলত মিয়ানমারের নাগরিক। ধর্মীয় পার্থক্য ও বৈপরীত্যের কারণেই রোহিঙ্গাদের উপর এমন নির্যাতন চালানো হচ্ছে। মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর সামরিক শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, অমানবিক এবং নৃশংস হত্যাকা-ের মাধ্যমে মুসলমান শূন্য করার খেলায় মেতে উঠেছে। নিরীহ রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর এ নৃশংস বর্বরতার নিন্দা জানানোর ভাষা অভিধানে আজ পরাজিত! বার্মার মজলুম রোহিঙ্গা মুসলমানের কান্নায় পৃথিবীর আকাশ ভারি হয়ে ওঠছে। মুসলিম নারী-পুরুষ ও শিশুরা বাঁচাও বাঁচাও বলে আর্তচিৎকার করছে। মিয়ানমারের বর্বর সরকার তাদের ওপর নির্যাতনের স্টিম রোলার চালাচ্ছে। হত্যা করছে অসংখ্য নিষ্পাপ শিশু, যুবক, বৃদ্ধাদের। ধর্ষণ করে কলঙ্কিত করছে অসংখ্য মা-বোনদের। বিধবা করছে হাজারো নারীদের। সন্তানহারা করছে অসংখ্য মাকে। মজলুম রোহিঙ্গা মুসলমানদের আহাজারিতে পৃথিবীর আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠছে। কোথায় আজ বিশ্ব মুসলমানদের সহযোগিতা ও ভ্রাতৃত্বের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত সংস্থা ওআইসি। নীরব কেন আজ মানবাধিকার সংস্থা? নিশ্চুপ কেন জাতিসংঘ?। পৃথিবীতে দেড়শ কোটি মুসলমান থাকার পরও কেন আরাকান রাজ্যের মুসলমান ও হিন্দুরা আজ নির্যাতিত? রোহিঙ্গাদের ওপর নির্মম নির্যাতন এটা পরিষ্কার করে দিয়েছে যে গোটা বিশ্বের অমুসলিম শক্তি আজ মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ। আমরা এখনও নিশ্চুপ! রোহিঙ্গা মুসলমানদের কিই বা দোষ ছিল, যার কারণে তাদের আজ নির্মম-জুলুম নির্যাতন ভোগ করতে হচ্ছে? কারণ একটাই ওরা যে মুসলমান আর মুসলমানদের চেহেরায় হিন্দু সম্প্রদায়।

মজলুম রোহিঙ্গা এবং হিন্দুদের বীভৎস চেহারাগুলো দেখে কার চোখ না অশ্রুসিক্ত হবে? আপনার সামনে আপনার ভাই-বোন, মা-বাপ, ছেলেমেয়েদের যদি আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে, শরীরের ওপর কামান তুলে মাথার মগজ বের করে ফেলে, চোখের সামনে তাজাদেহ দ্বিখডি-ত করে ফেলে তখন আপনার কেমন লাগবে? আহ! বার্মার মুসলমানদের সাথে তাই করা হচ্ছে! জাতিসংঘ রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে বিশ্বের সবচেয়ে বর্বর নির্যাতনের শিকার জনগোষ্ঠী হিসেবে অভিহিত করেছে।

জাতিসংঘের তথ্যমতে, রোহিঙ্গারা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ভাগ্যাহত জনগোষ্ঠী। শত শত বছর ধরে তারা নির্যাতিত ও নিপিড়ীত হচ্ছে। নির্যাতনের চিত্রগুলো বিশ্বমিডিয়ায় প্রকাশ পেয়েছে। নির্বিচারে হত্যা ও নারীদেরকে ধর্ষণের শিকার হতে হচ্ছে রোহিঙ্গাদের। সম্পত্তি জোর করে কেড়ে নেয়াসহ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবার সুযোগ দেয়া হয় না। তাদের সংখ্যা যাতে বাড়তে না পারে সে জন্য বিয়ে করার অনুমতি দেয়া হয় না। ধর্মীয় ইবাদত-বন্দেগী পালনেও বাঁধা দেয়া হয়। বৌদ্ধ রাখাইনদের টার্গেট হলো নিরস্ত্র রোহিঙ্গা মুসলিম ও হিন্দু জনগোষ্ঠীকে নির্যাতনের মাধ্যমে নির্মূল করা। সেই লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার, কেন্দ্রীয় সরকার ও সেনাবাহিনী পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গা এবং হিন্দুদেরকে দেশ থেকে বের করে দিতেই হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে।তাই মানবিক দৃষ্টিতে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের শরনার্থীদেরকে সার্বিক সহযোগিতা বাচিয়ে রাখতে হবে আমাদের।

রোহিঙ্গা মুসলামানদের নির্যাতনের মূল হোতা ও আতঙ্কের নাম ”অসনি”

মুসলিমদের ওপর নির্যাতনের মূল হোতা ‘অসিন’ নামের এক ধর্মগুরুর কথা। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর বর্বর নির্যাতনের প্রধান আসামি। ২০০৩ সালে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর দায়ে তার ২৫ বছরের জেল হয়। তবে মুসলিমবিরোধী প্রচারণার কারণে ২০০৩ সাল থেকে ৭ বছর জেলে ছিলেন। পরবর্তীতে ২০১০ সালে জেল থেকে মুক্তি লাভ করে তিনি নিজেকে মিয়ানমারের ‘উসামা বিন লাদেন’ হিসেবে প্রচার করেন। তখন থেকে তিনি ইউটিউব ও ফেসবুকের মত মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচারণা চালাতে থাকেন। ২০০১ সালে তিনি মুসলিমবিদ্বেষী গোষ্টী ‘৯৬৯ সড়াবসবহঃ’ এ যোগ দেন। এ সংগঠনের নেতৃত্বে রয়েছেন উইরাথু নামের বৌদ্ধভিক্ষু। তার বিরুদ্ধে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উৎপীড়ন চালানোর জন্য উস্কে দেয়ার অভিযোগ থাকলেও তিনি নিজেকে একজন শান্তিপ্রিয় ধর্মযাজক হিসেবেই দাবি করেন। অবশ্য তিনি প্রকাশ্যে মুসলমানদেরকে শত্রু বলে ঘোষণা করেন।

২০১৩ সালের জুন মাসে প্রকাশিত টাইম ম্যাগাজিনের কাভার পেজে তাকে ‘ঞযব ঋধপব ড়ভ ইঁফফযরংঃ ঞবৎৎড়ৎ’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। ‘তুমি দয়ামায়া ভালবাসায় পরিপূর্ণ হতে পারো, কিন্তু তুমি পাগলা কুত্তার পাশে ঘুমাতে পারো না’- মুসলমানদের উদ্দেশ্য করে বলা তার বচন। তিনি আরো বলেন যে, আমরা যদি দুর্বল হয়ে যায়, তবে আমাদের ভুমি একদিন মুসলিমদের হয়ে যাবে।’ রোহিঙ্গা মুসলিম নিধন আন্দোলনের কলকাঠি নাড়ছে বৌদ্ধদের চরমপন্থী সংগঠন‘ ‘৯৬৯ সড়াবসবহঃ ড়ভ ইঁফফযরংঃ’ স্বঘোষিত মিয়ানমারের ‘ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক শুধু বৌদ্ধদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে’। অন্যসকল ধর্মালম্বী বিশেষ করে রোহিঙ্গা মুসলিম নির্মূলে উইরাথু ও তার মতাদর্শীরা ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ-ধর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে। বিগত কয়েক দশক থেকেই রোহিঙ্গা মুসলমানদের হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ চলছিল। বর্তমানে অভিবাসী সমস্যা প্রবল আকার ধারণ করার পর বিশ্বব্যাপী রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষের স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত স্পষ্ট হওয়ায় উইরাথুর অসিনের নেতৃত্বাধীন সমর্থকগোষ্টী সরকারি বাহিনীর সহায়তায় রোহিঙ্গা মুসলমানদের ‘হত্যার উৎসব’ পালন করছে।

বিশ্ব বৌদ্ধদের করণীয় :

মিয়ানমার এবং সে দেশের জনগণ বুদ্ধের বাণীকে মান্য করলে কিছুতেই এমন মানবতাবিরোধী কাজে লিপ্ত হতে পারে না বা তা মেনে নিতে পারে না। মিয়ানমারের এই আচরণ সমগ্র বিশ্বের বৌদ্ধদের জন্য চরম লজ্জার। তাই এই সময়ে বৌদ্ধ রাষ্ট্রগুলোর উচিত মিয়ানমারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কথা বলা। বাংলাদেশি বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সর্বোচ্চ সাংঘিক সংগঠন বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি দেওয়া যেতে পারে। বৌদ্ধদের বিভিন্ন সংগঠন মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধে দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিতে পারে, সোচ্চার হতে পারে। মিয়ানমারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কথা বলা এবং প্রতিবাদ জানানোর দায়িত্ব কেবল শুধু বাংলাদেশের কিংবা মুসলমানদের নয়– এটা সমগ্র বিশ্বনেতৃত্ব ও বিশ্ববাসীর নৈতিক দায়িত্ব। মুসলিম নির্যাতিত হলে আরব বিশ্ব, অমুসলিম নির্যাতিত হলে হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টান বিশ্বকে সোচ্চার হতে হবে এমন সংকীর্ণ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে।